কাগজ কিভাবে তৈরি হয় জেনে নিন

কাগজ কিভাবে তৈরি হয় ও কাগজ ও কাগজ কোন গাছ থেকে তৈরি করা হয় এবং কাগজ তৈরির মূল উপাদান কি? এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে আজকের এই পোস্টটিটতে। বিস্তারিত জানতে এই পোস্টটির সাথেই থাকুন।
তাহলে চলুন, আজকের এই পোস্টটি পড়ার মাধ্যমে জেনে নিন কাগজ কিভাবে তৈরি হয় সে সম্পর্কে। আরও জেনে নিন কাগজ তৈরির রাসায়নিক উপাদান ও কাজের প্রকারভেদ। সুপ্রিয় পাঠক, আসুন পোস্টটির মূল আলোচনায় যাওয়া যাক

ভূমিকা। কাগজ কে আবিষ্কার করেন?

কাগজ আবিষ্কার করেন চীনের রাজকর্মচারী "কাই লুন (Cai Lun)"। তিনি খ্রিস্টীয় ১০৫ সালে কাগজ আবিষ্কার করেন।তিনি ছিলেন প্রাচীন চীন, হান রাজবংশ। 

তিনি কাগজ তৈরির জন্য উপকরণ হিসেবে পুরনো কাপড়, গাছের ছাল, মাছের জাল ইত্যাদি ব্যবহার করে প্রথম কাগজ তৈরি করেন। 

কাই লুন-এর তৈরি কাগজ ছিল হালকা, সহজে লেখা যায়, এবং তুলনামূলকভাবে সস্তা — তাই ধীরে ধীরে এটি চীনের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে:
  • চীন থেকে → মধ্য এশিয়া (আরব দুনিয়া)
  • আরব দুনিয়া থেকে → ইউরোপ
  • ইউরোপ থেকে → সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

কাগজ কিভাবে তৈরি হয়?

নিচে কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো, কাগজ কিভাবে তৈরি হয় – ধাপে ধাপে বিস্তারিত বর্ণনা-

ধাপ ১: কাঁচামাল সংগ্রহ: প্রথমে কাগজ তৈরির জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়। মূল উপাদান হলো গাছের কাঠ, বাঁশ, পুরনো কাগজ বা উদ্ভিদের আঁশ। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়:
  • পাইনের গাছ (Softwood)
  • ইউক্যালিপটাস গাছ (Hardwood)
  • বাঁশ ও পুরাতন কাগজ (Recycled material)
ধাপ ২: কাঠ টুকরো করা ও পাল্প তৈরি: কাঠকে ছোট ছোট টুকরো করে কাটা হয়। এরপর এই কাঠের টুকরোগুলোকে পাল্প (Pulp) বানানো হয়। পাল্প হলো একধরনের তরল মিশ্রণ, যাতে থাকে সেলুলোজ ফাইবার।

পাল্প তৈরির দুইটি প্রধান পদ্ধতি রয়েছে:

(ক) মেকানিক্যাল পদ্ধতি: শুধু মেশিনে কাঠ পিষে ফাইবার বের করা হয়।
(খ) কেমিক্যাল পদ্ধতি: কাঠের আঁশ থেকে লিগনিন (Lignin) নামের আঠালো উপাদান আলাদা করতে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH) ও সোডিয়াম সালফাইড (Na₂S) ব্যবহার করা হয়।

ধাপ ৩: ব্লিচিং (সাদা করা): পাল্প সাদা করার জন্য ব্লিচিং করা হয়। এতে ব্যবহার হয়:
  • হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড (H₂O₂)
  • ক্লোরিন ডাইঅক্সাইড (ClO₂)
এই ধাপে কাগজের রঙ উজ্জ্বল ও লেখার উপযোগী হয়।

ধাপ ৪: পাতলা কাগজের শিট তৈরি: সাদা পাল্পকে পানি মিশিয়ে একটি বড় চলন্ত ছাঁকনির (screen বা mesh) ওপর ফেলা হয়। এতে পানি ঝরে যায় এবং উপরে সেলুলোজ ফাইবার জমে পাতলা একটুকরো কাগজের মতো শিট তৈরি হয়।

ধাপ ৫: শুকানো: এই কাঁচা শিটটিকে বিশাল রোলার ও গরম চেম্বারের সাহায্যে শুকানো হয়। এতে কাগজের মধ্যে থাকা আর্দ্রতা (পানি) পুরোপুরি চলে যায়।

ধাপ ৬: চাপ ও পালিশ করা (Finishing): কাগজকে মসৃণ ও চকচকে করতে এটি রোলারের নিচ দিয়ে চালানো হয় এবং প্রয়োজনে স্টার্চ বা আঠা লাগানো হয়। অনেকে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (CaCO₃) বা চিনামাটি (Clay) ব্যবহার করে পৃষ্ঠ মসৃণ করে।

ধাপ ৭: কাটা ও মোড়কজাত করা: শেষ ধাপে কাগজকে রোল বা শীট আকারে কাটা হয় এবং প্যাকেট বানিয়ে বাজারজাত করা হয়।

সংক্ষেপে কাগজ তৈরির ধাপসমূহ:

১. কাঠ সংগ্রহ
২. পাল্প তৈরি
৩. ব্লিচিং
৪. শিট তৈরি
৫. শুকানো
৬. মসৃণ ও পালিশ
৭. কাটা ও প্যাকিং

কাগজ কোন গাছ থেকে তৈরি হয়

কাগজ সাধারণত গাছের কাঠ থেকে তৈরি হয়, আর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে:

১. দাতুরা গাছ (Pine tree) – নরম কাঠ (softwood) হিসেবে পরিচিত, যেটা সহজে প্রসেস করা যায়।

২. ইউক্যালিপটাস (Eucalyptus) – দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং এর কাঠ কাগজ তৈরিতে বেশ উপযোগী।

৩. বাঁশ (Bamboo) – বিশেষ করে এশিয়ার কিছু দেশে বাঁশ থেকেও কাগজ তৈরি করা হয়।

৪. ব্রিচ, ম্যাপল, ওক ইত্যাদি হার্ডউড গাছ – কিছু ক্ষেত্রে শক্ত কাঠের গাছও ব্যবহার হয়, বিশেষ করে উচ্চমানের কাগজ তৈরিতে।

তবে মূল উপাদান হলো সেলুলোজ ফাইবার, যেটা এই গাছগুলোর কাঠ থেকে বের করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।

কাগজ তৈরির মূল উপাদান কি?

কাগজ তৈরির মূল উপাদান হলো সেলুলোজ (Cellulose)।সেলুলোজ হচ্ছে গাছের কাঠ বা উদ্ভিদের আঁশ থেকে পাওয়া এক ধরনের প্রাকৃতিক ফাইবার। 

এই ফাইবারকে পানি ও রাসায়নিক দিয়ে গলিয়ে পাল্প (pulp) তৈরি করা হয়, তারপর সেটিকে চেপে, শুকিয়ে এবং মসৃণ করে কাগজে রূপান্তর করা হয়।

সংক্ষেপে, কাগজ তৈরির মূল উপাদানগুলো হলো:
  • সেলুলোজ ফাইবার – প্রধান উপাদান (গাছ, বাঁশ বা কৃষিজ বর্জ্য থেকে আসে)
  • পানি – পাল্প তৈরি ও প্রক্রিয়াজাত করতে
  • কেমিক্যালস – যেমন সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড বা ব্লিচ, কাঠের আঁশ নরম ও সাদা করতে
  • স্টার্চ/আঠা (গাম) – কাগজের গুণমান বাড়াতে

কাগজ তৈরির রাসায়নিক উপাদান

কাগজ তৈরির সময় বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে কাঠের আঁশ থেকে সেলুলোজ আলাদা করতে ও কাগজের গুণমান উন্নত করতে। নিচে কাগজ তৈরিতে ব্যবহৃত প্রধান রাসায়নিক উপাদানগুলো দেওয়া হলো:

১. সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH): কাঠের লিগনিন (lignin) ভেঙে ফেলতে সাহায্য করে। সেলুলোজকে আলাদা করে।

২. সোডিয়াম সালফাইড (Na₂S):  লিগনিন অপসারণে সহায়তা করে। কাগজ নরম রাখতে সহায়ক।

৩. ক্লোরিন বা ক্লোরিন ডাইঅক্সাইড (Cl₂ / ClO₂): কাগজ সাদা করতে ব্যবহার হয় (ব্লিচিং প্রক্রিয়ায়)

৪. হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড (H₂O₂):  পরিবেশবান্ধব ব্লিচিং এজেন্ট। কাগজকে উজ্জ্বল ও সাদা করে।

৫. স্টার্চ বা আঠা (Gum / Starch): কাগজকে মসৃণ ও মজবুত করতে। লেখার জন্য উপযুক্ত করে তোলে

৬. ক্যালসিয়াম কার্বোনেট বা ক্লে (CaCO₃ / Clay): কাগজের পৃষ্ঠকে মসৃণ ও উজ্জ্বল করতে ব্যবহৃত হয়। প্রিন্টিং কোয়ালিটি বাড়াতে সাহায্য করে

এই রাসায়নিকগুলো কাগজ তৈরির ভিন্ন ধাপে ব্যবহৃত হয়—মূলত পাল্প প্রস্তুত, ব্লিচিং, ও ফিনিশিং পর্যায়ে।

তুমি কি চাও আরও বিস্তারিতভাবে কোন ধাপে কী রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়?

কাগজ কত প্রকার?

কাগজ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে, তার গঠন, ব্যবহার ওগুণমান অনুযায়ী। সাধারণভাবে কাগজকে নিচের প্রকারভেদে ভাগ করা যায়:

১. ব্যবহারের ভিত্তিতে:

(ক) লেখার ও ছাপার কাগজ:
  • বন্ড পেপার: অফিসের কাজে ব্যবহৃত, ভালো মানের
  • অফসেট পেপার: প্রিন্টিং প্রেসে ব্যবহৃত
  • নিউজপ্রিন্ট: পত্রিকা ছাপাতে ব্যবহৃত হালকা কাগজ

(খ) শিল্পে ব্যবহৃত কাগজ:
  • ক্রাফট পেপার: ব্যাগ বা প্যাকেট তৈরিতে ব্যবহৃত শক্ত কাগজ
  • কার্ডবোর্ড / বোর্ড পেপার: বাক্স বা কভার তৈরিতে ব্যবহৃত
  • কোটেড পেপার: চকচকে প্রিন্টিং বা ম্যাগাজিনের জন্য ব্যবহৃত
(গ) বিশেষ ব্যবহারের কাগজ:
  • ফটো পেপার: ছবি ছাপাতে ব্যবহৃত
  • পার্চমেন্ট পেপার: রান্নায় ব্যবহৃত তেলরোধী কাগজ
  • টিস্যু পেপার: মুখ-মুছা বা টয়লেট ব্যবহারের জন্য
২. গঠন ও আবরণের ভিত্তিতে:
  • সাদা কাগজ (Plain Paper)
  • রঙিন কাগজ (Colored Paper)
  • চকচকে বা গ্লোসি পেপার (Glossy Paper)
  • ম্যাট পেপার (Matte Paper)
৩. কাঁচামালের ভিত্তিতে:
  • কাঠভিত্তিক কাগজ (Wood-based)
  • বাঁশভিত্তিক কাগজ (Bamboo-based)
  • রিসাইকেল কাগজ (Recycled paper)

মন্তব্য। কাগজ কিভাবে তৈরি হয়

পাঠক, আশা করি আজকের এই আর্টিকেলটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারী ও ধৈর্য ধরে পড়েছেন। পড়ার মাধ্যমে ইতিপূর্বে জানতে পেরেছেন কাগজ কিভাবে তৈরি হয়। আপনাদের যদি এই আর্টিকেলটি পড়ে ভালো লেগে থাকে। তবে আপনাদের প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন।

এই রকম আরোও গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল পেতে নিয়মিত আমার www.sumonworld.com ওয়েবসাইটটি পরিদর্শন করুন। আবারও দেখা হবে নতুন কোন এক আর্টিকেলের মাধ্যমে। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। ভাল থাকুন এবং প্রিয়জনদের ভালবাসুন। আল্লাহ হাফেজ

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url