ইসলামে ব্যবসার মূলনীতি, গুরুত্ব ও ইসলামে নিষিদ্ধ ব্যবসা

ইসলামে ব্যবসার মূলনীতি, গুরুত্ব ও ইসলামে নিষিদ্ধ ব্যবসা আলোচনা করতে চলেছি আজকের এই আর্টিকেলটিতে। আপনি কি ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবছেন। এবং সেটা ইসলামিক পরিপন্থী অবলম্বন করে করতে চাইছেন। তাহলে আপনাকে এই ওয়েবসাইটে স্বাগতম।
কেননা আজকের এই আরর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে বিস্তারিত ভাবে জানতে পারবেন ইসলামে ব্যবসার মূলনীতি, গুরুত্ব ও ইসলামে নিষিদ্ধ ব্যবসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। চলুন, আর্টিকেলটির মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।

ইসলামে ব্যবসার মূলনীতি

ইসলামে ব্যবসার (বাণিজ্যের) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। কুরআন ও হাদীসে ব্যবসাকে হালাল রুজির অন্যতম প্রধান মাধ্যম বলা হয়েছে। 

তবে ইসলাম ব্যবসায় কিছু মূলনীতি ও নৈতিক দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করেছে, যাতে লেনদেন ন্যায়সঙ্গত, স্বচ্ছ ও আল্লাহভীতির ভিত্তিতে হয়। নিচে ইসলামে ব্যবসার প্রধান মূলনীতিগুলো দেওয়া হলো:

১) হালাল ও হারাম পার্থক্য মেনে চলা: ব্যবসা এমন জিনিসে করা যাবে না যা ইসলাম হারাম করেছে (যেমন: মদ, সুদ, জুয়া, শূকর ইত্যাদি)।

আল-কুরআন: “হে মুমিনগণ! তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।” – (সূরা আন-নিসা ৪:২৯)

২) সুদ (রিবা) নিষিদ্ধ: ইসলামে সুদকে কঠোরভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। “আল্লাহ বেচাকেনাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।” – (সূরা আল-বাকারা ২:২৭৫)

৩️)  সত্যবাদিতা ও আমানতদারিতা বজায় রাখা: ব্যবসায় প্রতারণা, মিথ্যা ও লুকোচুরি নিষিদ্ধ। রাসূল ﷺ বলেছেন: “যে বিক্রেতা ও ক্রেতা দুজনই সত্য বলে ও সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে, তাদের বেচাকেনায় বরকত থাকে।” – (সহিহ বুখারী)

৪️) ওজন ও পরিমাপে সঠিকতা: ওজন বা পরিমাপে কম দেওয়া বড় গুনাহ। “ধ্বংস তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়।” – (সূরা আল-মুতাফফিফিন ৮৩:১)

৫️) পারস্পরিক সম্মতি থাকা: লেনদেনে দুই পক্ষেরই স্বাধীন ও খুশিমনে সম্মতি থাকা আবশ্যক। জোরপূর্বক বা প্রতারণার মাধ্যমে ব্যবসা বৈধ নয়।

“তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে বাণিজ্য করো।” – (সূরা আন-নিসা ৪:২৯)

৬️) প্রতারণা ও ধোঁকা নিষিদ্ধ: রাসূল ﷺ বলেছেন: “যে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” – (সহিহ মুসলিম)

৭️) ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ: অন্যায়ভাবে দাম বাড়ানো বা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হারাম।

৮️) জাকাত ও দান: ব্যবসার মুনাফা থেকে জাকাত আদায় করা ফরজ, যা সমাজে সম্পদের ভারসাম্য রক্ষা করে।

৯️)  আল্লাহভীতি ও নৈতিকতা: ব্যবসায় আল্লাহকে স্মরণ রাখা, নামাজে অবহেলা না করা, ও নৈতিক আচরণ বজায় রাখা জরুরি।

“যে ব্যবসা ও বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখে না, তারাই সফল।” – (সূরা আন-নূর ২৪:৩৭)

ইসলামী ব্যবসার মূলনীতি হলো — সত্য, ন্যায়, হালাল, পরিমাপে সততা, ও পারস্পরিক সম্মতি।

ইসলামে ব্যবসার গুরুত্ব

ইসলামে ব্যবসার গুরুত্ব খুবই বেশি। ইসলাম ব্যবসাকে শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং ইবাদতের অংশ হিসেবেও গণ্য করেছে। 

কুরআন ও হাদীসের বহু স্থানে ব্যবসাকে উৎসাহিত করা হয়েছে, তবে ন্যায়, সততা ও আল্লাহভীতির ভিত্তিতে তা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

ইসলামে ব্যবসার গুরুত্ব নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা উল্লেখ করা হলো:

১️) হালাল রুজির প্রধান মাধ্যম: ব্যবসা হলো হালাল উপায়ে জীবিকা অর্জনের অন্যতম উত্তম পন্থা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।” – (তিরমিজি)

২️) নবীদের আমল: অনেক নবী ব্যবসা করতেন। যেমন— হজরত মুহাম্মদ ﷺ তরুণ বয়সে বাণিজ্য করতেন। এটি প্রমাণ করে যে ব্যবসা সম্মানজনক একটি পেশা।

৩️) অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যম: ব্যবসার মাধ্যমে মানুষ নিজের ও সমাজের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করতে পারে। এতে বেকারত্ব কমে এবং সমাজে স্বচ্ছলতা আসে।

৪️) সততা ও ন্যায়পরায়ণতার চর্চা: ব্যবসা মানুষকে সত্যবাদী, আমানতদার ও ন্যায়পরায়ণ হতে শেখায়। ইসলামে প্রতারণা, মিথ্যা, সুদ ও চুরি থেকে দূরে থেকে ব্যবসা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

৫️) সমাজে সহযোগিতা ও কল্যাণ সৃষ্টি: ব্যবসার মাধ্যমে সমাজের প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ হয়, দারিদ্র্য কমে এবং জাকাত ও দান দ্বারা দরিদ্ররা উপকৃত হয়।

সংক্ষেপে বলা যায়: ইসলামে ব্যবসা শুধু জীবিকা অর্জনের পথ নয়, বরং এটি ইমান, সততা ও আল্লাহভীতির পরীক্ষার একটি মাধ্যম। যে ব্যক্তি হালাল পথে সৎভাবে ব্যবসা করে, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করে।

ইসলামে নিষিদ্ধ ব্যবসা

ইসলামে ব্যবসা করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, তবে কিছু ব্যবসা স্পষ্টভাবে হারাম (নিষিদ্ধ) করা হয়েছে, কারণ এসব ব্যবসা মানুষের ক্ষতি করে, অন্যায় লাভ এনে দেয় বা সমাজে অনৈতিকতা ছড়ায়। 

নিচে ইসলামে নিষিদ্ধ ব্যবসাগুলো সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হলো। ইসলামে নিষিদ্ধ ব্যবসা নিচে দেওয়া হলো:

১️) সুদভিত্তিক ব্যবসা (রিবা): ইসলামে সুদ (রিবা) কঠোরভাবে হারাম। ব্যাংক সুদ বা ঋণে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা অন্যায়।

আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ বেচাকেনাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।” – (সূরা আল-বাকারা ২:২৭৫)

২️) হারাম পণ্যের ব্যবসা: যেসব জিনিস ইসলাম হারাম করেছে, সেগুলোর ব্যবসা করা নিষিদ্ধ। যেমন:
  • মদ বা নেশাজাত দ্রব্য
  • শূকরের মাংস
  • মৃত প্রাণীর মাংস
  • জুয়া বা লটারির ব্যবসা
  • পর্নোগ্রাফি বা অনৈতিক পণ্য
৩️) প্রতারণামূলক ব্যবসা: জিনিসের ত্রুটি লুকিয়ে বিক্রি করা, মিথ্যা কথা বলা বা ভেজাল মেশানো ব্যবসা হারাম। রাসূল ﷺ বলেছেন: “যে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” – (সহিহ মুসলিম)

৪️) ওজন ও পরিমাপে কম দেওয়া: ইচ্ছা করে ওজন বা পরিমাপে কম দেওয়া বড় গুনাহ। “ধ্বংস তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়।” – (সূরা আল-মুতাফফিফিন ৮৩:১)

৫️) জুয়া ও বাজি ধরা: লাভ-ক্ষতি ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে এমন ব্যবসা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে, কারণ এতে শ্রম ও ন্যায়বিচার নেই। 

“হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি ও ভাগ্য নির্ধারণের তীর — এগুলো শয়তানের অপবিত্র কাজ।” – (সূরা আল-মায়িদা ৫:৯০)

৬️) অন্যায়ভাবে দাম বাড়ানো বা সংকট সৃষ্টি করা: কৃত্রিমভাবে জিনিসপত্রের সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো (মজুতদারি) ইসলাম হারাম করেছে।

সংক্ষেপে বলা যায়: ইসলামে সেইসব ব্যবসা নিষিদ্ধ যা মানুষের ক্ষতি করে, প্রতারণা বা অন্যায় লাভের পথ খুলে দেয়। হালাল পথে, সত্য ও ন্যায়ের সঙ্গে ব্যবসা করাই ইসলামের নির্দেশ।

ব্যবসা নিয়ে ইসলামিক উক্তি

নিচে কিছু সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক উক্তি (আয়াত ও হাদীস) দেওয়া হলো যা ব্যবসা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কারভাবে বোঝায়। ব্যবসা নিয়ে ইসলামিক উক্তি নিম্নরূপ:

১। কুরআনের আয়াতসমূহ:

ক) আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ বেচাকেনাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।” — সূরা আল-বাকারা (২:২৭৫)

“তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে বাণিজ্য করো।”  সূরা আন-নিসা (৪:২৯)

“ধ্বংস তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়।” সূরা আল-মুতাফফিফিন (৮৩:১)

“যে ব্যবসা ও বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখে না, তারাই সফল।” — সূরা আন-নূর (২৪:৩৭)

২।  হাদীসের উক্তিসমূহ:

খ) রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।” — (তিরমিজি)

“যে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” — (সহিহ মুসলিম)

“বিক্রেতা ও ক্রেতা দুজনই যদি সত্য কথা বলে ও সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে, তাহলে তাদের বেচাকেনায় বরকত থাকে; কিন্তু যদি তারা মিথ্যা বলে ও গোপন করে, তবে বরকত চলে যায়।”
— (সহিহ বুখারী)

“সবচেয়ে উত্তম উপার্জন হলো সেই উপার্জন, যা মানুষ নিজ হাতে পরিশ্রম করে অর্জন করে এবং হালাল পথে লাভ করে।”
— (আল-হাকিম)

সংক্ষিপ্ত ইসলামিক উক্তি:

“সৎ ব্যবসায় বরকত আছে, প্রতারণায় ধ্বংস।” 

“হালাল পথে উপার্জন করো — তাতেই আছে দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি।”

“আল্লাহ সেই ব্যবসায় বরকত দেন, যেখানে সততা ও ন্যায়পরায়ণতা থাকে।

ব্যবসার ফজিলত সম্পর্কে হাদিস

ইসলামে ব্যবসা একটি সম্মানজনক ও বরকতময় পেশা। কুরআন ও হাদীসে ব্যবসার অনেক ফজিলত (গুণ ও মর্যাদা) বর্ণনা করা হয়েছে। নিচে ব্যবসার ফজিলত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ হাদীসগুলো দেওয়া হলো। 

ক) সত্যবাদী ব্যবসায়ীর মর্যাদা: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন “সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।”(তিরমিজি, হাদীস: ১২০৯)

এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, একজন সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী আখিরাতে অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা লাভ করবেন।

খ) হালাল রুজি সর্বোত্তম উপার্জন: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছে “সবচেয়ে উত্তম উপার্জন হলো সেই উপার্জন, যা মানুষ নিজ হাতে পরিশ্রম করে এবং হালাল পথে অর্জন করে।” (আল-হাকিম, মুসতাদরাক ২:১০)

অর্থাৎ, নিজের পরিশ্রমে ও সৎ উপায়ে ব্যবসা করে রোজগার করা আল্লাহর কাছে প্রিয়।

গ) ব্যবসায়ে বরকত থাকে সততা ও সত্যে: রাসূল ﷺ বলেছেন। “যদি ক্রেতা ও বিক্রেতা সত্য কথা বলে এবং জিনিসের ত্রুটি প্রকাশ করে, তবে তাদের লেনদেনে বরকত থাকে। 

কিন্তু যদি তারা মিথ্যা বলে ও গোপন করে, তবে বরকত চলে যায়।” (সহিহ বুখারী, হাদীস: ২০৭৯)

,
ঘ) সৎ ব্যবসায়ীর প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন — “সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবে।”  (বায়হাকি, শু‘আবুল ঈমান)

ঙ) ব্যবসা ইবাদতের সমতুল্য: একজন সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন: “হে আল্লাহর রাসূল, কোন উপার্জন সর্বোত্তম?”

রাসূল ﷺ বললেন: “মানুষের হাতে পরিশ্রমের উপার্জন এবং প্রত্যেক বৈধ (হালাল) ব্যবসা।” (আহমদ, মুসনাদ ৪:১৪১)

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url