থাইরয়েড কমানোর ঘরোয়া উপায় জেনে নিন
থাইরয়েড একটি অতি পরিচিত রোগ। পুরুষদের তুলনায় মহিলারা বেশি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তাই থাইরয়েড কমানোর ঘরোয়া উপায় নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি আজকের এই পোস্টটিতে।
তাহলে, চলুন কথা না বাড়িয়ে আজকের আলোচ্য বিষয় থাইরয়েড কমানোর ঘরোয়া উপায় জানতে এই পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
থাইরয়েড কমানোর ঘরোয়া উপায়
থাইরয়েড কমানোর জন্য কিছু ঘরোয়া উপায় আছে, তবে প্রথমে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরি। নিচে কয়েকটি সাধারণ ঘরোয়া টিপস দিলাম যেগুলো থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে:
আয়োডিন গ্রহণ বাড়ানো: থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে আয়োডিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। আইডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করুন এবং সামুদ্রিক মাছ, দুধ, ডিম ইত্যাদি খেতে পারেন।
সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ খাবার: সেলেনিয়াম থাইরয়েড হরমোন মেটাবলিজমে সাহায্য করে। ব্রাজিল নাট, বাদাম, সূর্যমুখীর বীজ খেতে পারেন।
জাঙ্ক ফুড এবং প্রসেসড ফুড এড়ানো: প্রক্রিয়াজাত খাবার ও অতিরিক্ত চিনি থাইরয়েডের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রচুর পানি পান করা: ডিহাইড্রেশন কমাতে প্রচুর পানি পান করুন। এবং তরল জাতীয় খাবার বেশি খান।
নিয়মিত ব্যায়াম: হালকা হাঁটা বা যোগব্যায়াম করতে পারেন, যা মেটাবলিজম বাড়ায়।
স্ট্রেস কমানো: স্ট্রেস থাইরয়েড সমস্যাকে বাড়াতে পারে, তাই মেডিটেশন বা রিল্যাক্সেশন টেকনিক ব্যবহার করুন।
ক্রুসিফেরাস সবজি পরিমিত খাওয়া: ব্রকোলি, ফুলকপি ইত্যাদি বেশি খেলে কিছু ক্ষেত্রে থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা হতে পারে, তাই পরিমিত খাওয়াই ভালো।
আবারো বলছি, যদি থাইরয়েডের সমস্যা থাকে, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া সবচেয়ে জরুরি। আপনি চাইলে আপনার অবস্থা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত বলতে পারেন, আমি আরও সাহায্য করতে পারি।
থাইরয়েড কমানোর ব্যায়াম
থাইরয়েড কমাতে সরাসরি কোনো বিশেষ ব্যায়াম না থাকলেও নিয়মিত শরীরচর্চা এবং বিশেষ কিছু যোগাসন মেটাবলিজম বাড়াতে এবং থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
নিচে কিছু কার্যকর ব্যায়াম এবং যোগাসন দিলাম যা থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে:
১. যোগাসন ও প্রণায়াম
- মৎস্যাসন (Fish Pose): ঘাড়ের পেশি ও থাইরয়েড গ্রন্থিকে উত্তেজিত করে, হরমোন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- ভুজঙ্গাসন (Cobra Pose):মেটাবলিজম বাড়ায় এবং থাইরয়েডের কার্যকারিতা উন্নত করে।
- সার্ভাঙ্গাসন (Shoulder Stand): থাইরয়েড গ্রন্থির রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়।
- উজ্জায়ি প্রণায়াম (Victorious Breath): শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, স্ট্রেস কমায় এবং থাইরয়েডের ভারসাম্য রক্ষা করে।
২. কার্ডিও ব্যায়াম
- হাঁটা বা দৌড়ানো: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা দৌড়ানো মেটাবলিজম বাড়াতে এবং শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- সাঁতার: সম্পূর্ণ শরীরের ব্যায়াম হওয়ায় থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে উপকারী।
৩. ওজন উত্তোলন: হালকা ওজন উত্তোলনের ব্যায়াম থাইরয়েড রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে, বিশেষ করে যারা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে চান।
৪. স্ট্রেচিং: নিয়মিত স্ট্রেচিং ব্যায়াম পেশি শিথিল করে এবং রক্তসঞ্চালন বাড়ায়।
মনে রাখবেন: থাইরয়েড সমস্যার ধরণ এবং শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ব্যায়ামের ধরন এবং মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। তাই ব্যায়াম শুরু করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
থাইরয়েড কমানোর খাবার
থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করার জন্য কিছু বিশেষ খাবার খুব উপকারী। নিচে এমন কয়েকটি খাবারের তালিকা দিলাম যা থাইরয়েড কমাতে সাহায্য করতে পারে। থাইরয়েড কমানোর জন্য খাবার হলো-
১। আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার
- আইডিনযুক্ত লবণ
- সামুদ্রিক মাছ (যেমন: স্যালমন, টুনা)
- শেলফিশ
- ডিম
- দুধ ও দুধজাত পণ্য
২। সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
- ব্রাজিল নাট
- বাদাম
- সূর্যমুখী বীজ
- ছোলা
- মাশরুম
৩। জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার
- গরুর মাংস
- কদমফুল
- বীফ
- বাদাম
৪। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল এবং সবজি
- ব্লুবেরি
- স্ট্রবেরি
- অরেঞ্জ
- শসা
- পালং শাক
৫৷ ফাইবারযুক্ত খাবার
- ওটস
- বাদাম
- ফলমূল
- সবজি
৬। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার
- মুরগির মাংস
- ডাল
- দই
- ছানা
খাবারের বিষয়ে কিছু সতর্কতা:
- অতিরিক্ত ক্রুসিফেরাস সবজি (যেমন: ব্রকোলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি) খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন, কারণ বেশি খেলে থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতা কমাতে পারে।
- প্রসেসড এবং জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলুন।
- অতিরিক্ত কফি ও চা এড়ানো ভালো।
থাইরয়েড নরমাল কত
থাইরয়েডের নর্মাল (স্বাভাবিক) মান মূলত থাইরয়েড হরমোন এবং TSH (থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন) এর রক্ত পরীক্ষা রিপোর্ট দেখে বোঝা যায়। সাধারণত নীচের মানগুলো স্বাভাবিক ধরা হয়:
- TSH (থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন): 0.4 থেকে 4.0 মাইক্রোইউনিট/মিলিলিটার (μIU/mL)।
- Free T4 (ফ্রি থাইরক্সিন): 0.8 থেকে 1.8 ন্যানোগ্রাম/ডিসিলিটার (ng/dL)।
- Free T3 (ফ্রি ট্রাইআইডোথাইরনাইন): 2.3 থেকে 4.2 পিকোগ্রাম/মিলিলিটার (pg/mL)।
যদি TSH বেশি হয়, তাহলে থাইরয়েড হরমোন কম থাকতে পারে (হাইপোথাইরয়ডিজম), আর TSH কম হলে থাইরয়েড হরমোন বেশি থাকতে পারে (হাইপারথাইরয়ডিজম)।
তবে মান কিছুটা ল্যাবভেদে বা ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার ওপরও নির্ভর করতে পারে। তাই রিপোর্ট পাওয়ার পর ডাক্তারের সাথে আলোচনা করাই সবচেয়ে ভালো।
থাইরয়েড কমানোর ঔষধ
থাইরয়েড কমানোর বা নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ নির্ভর করে থাইরয়েডের ধরণ ও রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর। মূলত দুই ধরনের থাইরয়েড সমস্যা ওষুধে চিকিৎসা করা হয়:
১. হাইপোথাইরয়ডিজম (থাইরয়েড কম কাজ করা): এই অবস্থায় থাইরয়েড হরমোনের অভাব হয়, তাই হরমোনের ঘাটতি পূরণের জন্য নিচের ওষুধ ব্যবহার হয়:
- Levothyroxine (লেভোথাইরোক্সিন) এটি থাইরয়েড হরমোনের সিন্থেটিক (কৃত্রিম) ফর্ম। ডোজ ও সময় ডাক্তারের নির্দেশমতো নিতে হবে।
২. হাইপারথাইরয়ডিজম (থাইরয়েড বেশি কাজ করা): এই অবস্থায় থাইরয়েড হরমোন বেশি উৎপাদন হয়, তাই হরমোন উৎপাদন কমানোর জন্য: Antithyroid drugs যেমন
- Methimazole (মেথিমাজল)
- Propylthiouracil (PTU)
এগুলো থাইরয়েড গ্রন্থিকে হরমোন তৈরি কমাতে সাহায্য করে।
পরামর্শ: কখনোই নিজের মতো করে ওষুধ বন্ধ বা পরিবর্তন করবেন না। ওষুধ সঠিক মাত্রায় ও নিয়মিত ব্যবহার করতে হবে। ডাক্তারের নিরীক্ষায় সময়ে সময়ে ব্লাড টেস্ট করানো জরুরি।
মহিলাদের মধ্যে থাইরয়েডের লক্ষণ
মহিলাদের মধ্যে থাইরয়েড সমস্যার লক্ষণ পুরুষদের থেকে কিছুটা বেশি এবং প্রায়ই বেশি স্পষ্ট হয়। থাইরয়েডের দুই ধরণের সমস্যায় (হাইপোথাইরয়ডিজম ও হাইপারথাইরয়ডিজম) মহিলাদের লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে। নিচে মহিলাদের থাইরয়েডের লক্ষ্মণগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. হাইপোথাইরয়ডিজম (থাইরয়েড কম কাজ করলে)
- ক্লান্তি ও দুর্বলতা
- ওজন বাড়া (খাবার কম খেয়েও)
- ঠান্ডা লাগা বেশি
- চুল পড়া বা চুলের ক্ষতি
- শুষ্ক ও মোটা চামড়া
- মন খারাপ, অবসাদ বা ডিপ্রেশন
- স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, মনোযোগ ঘাটতি
- মাসিক অনিয়ম বা বেশি মাসিক
- গলায় ফোলা বা গলায় গুটি
- কণ্ঠস্বর বদল
- পেশিতে জড়তা বা ব্যথা
- হঠাৎ মেজাজ পরিবর্তন বা উদ্বেগ
- প্রজনন সমস্যাও হতে পারে (গর্ভধারণে সমস্যা)।
২. হাইপারথাইরয়ডিজম (থাইরয়েড বেশি কাজ করলে)
- ওজন কমে যাওয়া
- দ্রুত বা অনিয়মিত হার্টের ধড়ফড়ানি
- অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
- হাত কাঁপানো
- উদ্বেগ, নার্ভাসনেস বা ঘুম কম হওয়া
- মাসিক অনিয়ম বা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া
- চোখ বেরিয়ে আসা (গ্রেভস ডিজিজে)
- গলার ফোলা বা গলায় গুটি
- পেশিতে দুর্বলতা
- খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, কিন্তু ওজন কমে যাওয়া।
মহিলাদের ক্ষেত্রে থাইরয়েডের সমস্যা প্রজনন ও গর্ভধারণেও প্রভাব ফেলতে পারে, তাই শারীরিক কোনো পরিবর্তন হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া জরুরি।
থাইরয়েড নিষিদ্ধ খাবার
থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে কিছু খাবার এড়ানো বা কম খাওয়া উচিত কারণ এগুলো থাইরয়েডের কার্যকারিতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। নিচে থাইরয়েড রোগীদের জন্য নিষিদ্ধ বা সীমিত খাবারের তালিকা দিলাম:
থাইরয়েডের জন্য নিষিদ্ধ বা সীমিত খাবার:
১। ক্রুসিফেরাস সবজি বেশি পরিমাণে
- ব্রকোলি
- ফুলকপি
- বাঁধাকপি
- শাকসবজি (বিশেষ করে কাঁচা)
এই সবজি বেশি খেলে থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে সমস্যা হতে পারে।
২। গ্লুটেন: বিশেষ করে সেলিয়াক ডিজিজ থাকলে গ্লুটেন (গম, বার্লি, রাই) এড়ানো উচিত কারণ গ্লুটেন থাইরয়েডের অটোইমিউন সমস্যা বাড়াতে পারে।
৩। সয়াবিন ও সয়াপণ্য: সয়া ও সয়া প্রোডাক্ট অতিরিক্ত খেলে থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতা কমাতে পারে।
৪। অতিরিক্ত কফি ও চা: বেশি কফি বা চা খেলে থাইরয়েড ওষুধের শোষণ কমে যেতে পারে।
৫। প্রসেসড ও জাঙ্ক ফুড: অতিরিক্ত চিনি, ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত লবণ থাইরয়েডের সমস্যা বাড়াতে পারে।
৬। অ্যালকোহল: অ্যালকোহল থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
৭। কিছু ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট: বিয়ান্টাইথাইরয়েড ওষুধ না নেওয়া অবস্থায় কোন ঔষধ বা সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
পরামর্শ: থাইরয়েড রোগের ধরণ অনুযায়ী খাবারের তালিকা ভিন্ন হতে পারে। তাই নিজের শারীরিক অবস্থান বুঝে ডাক্তারের বা ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিয়ে খাবার নিয়ন্ত্রণ করুন।
মন্তব্য। থাইরয়েড কমানোর ঘরোয়া উপায়
সুপ্রিয় পাঠক, আশা করি আজকের এই পোস্টটি মনোযোগ সহকারে সম্পূর্ণ পড়েছেন এবং পড়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন থাইরয়েড কমানোর ঘরোয়া উপায়।
আরও জানতে পেরেছেন থাইরয়েড কমানোর ব্যায়াম ও থাইরয়েড কমানোর খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। যদি এই পোস্টটি পড়ে ভালো লেগে থাকে তবে প্রিয়জনদের সাথে সেয়ার করুন।
ধন্যবাদ এতোক্ষণ আপনার মূল্যবান সময় দিয়ে থাইরয়েড কমানোর ঘরোয়া উপায় পোস্টির সাথে থাকার জন্য।❤️
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url