কোরবানির আসল উদ্দেশ্য কি-কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কয়টি

কোরবানির আসল উদ্দেশ্য কি-কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কয়টি সম্পর্কে জানার জন্য আপনি কি আগ্রহী?  তাহলে আপনাকে এই ওয়েবসাইটে স্বাগতম।
আজকে এই পোস্টটি পড়ার মাধ্যমে জানতে পারবেন কোরবানির আসল উদ্দেশ্য কি-কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। তাহলে চলুন পোস্টির মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।

কুরবানি কী?

কুরবানি (قربانی) ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর অর্থ: আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট পশু জবাই করা।

কুরবানির মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নিকটত্ব অর্জন করি এবং কুরআনের হুকুম পালন করি। মূলত, এটি হজরত ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) এর সুন্নত, যিনি আল্লাহর আদেশে তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) কে কুরবানী দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। 

সেই ঘটনার স্মরণে মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর ঈদুল আযহা (কুরবানীর ঈদ)-তে কুরবানী করে থাকে।

কুরবানির মূল কথা:
  • নির্দিষ্ট সময়ে (যিলহজ মাসের ১০, ১১, ১২ তারিখে)।
  • নির্দিষ্ট পশু (ছাগল, ভেড়া, গরু, উট)।
  • আল্লাহর জন্য জবাই করা।
কোরবানি করার মাধ্যমে একজন মুসলমান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং তাঁর নৈকট্য লাভ করে।

কোরবানির আসল উদ্দেশ্য কি?

কুরবানির আসল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাকওয়া (আল্লাহভীতি) প্রকাশ করা।

কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: "তাদের মাংস বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া (আল্লাহভীতি)।" (সূরা হজ, আয়াত ৩৭)

অর্থাৎ: কুরবানির পশুর মাংস বা রক্তের নয়, বরং আল্লাহর জন্য ত্যাগের মনোভাব আসল। এটি কেবল মাংস খাওয়া বা বিতরণের কাজ নয়, বরং আত্মসমর্পণ, আনুগত্য, ও আল্লাহর আদেশ মানার প্রমাণ।

কুরবানির শিক্ষা: মানুষের মধ্যে আত্মত্যাগের মানসিকতা তৈরি করা। গরীব-দুঃখীর সাথে খাবার ভাগাভাগি করে ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়ানো। 

নফস (আত্মা) সংযম করা। ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর শিক্ষা ও ত্যাগ স্মরণ করা।

কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কয়টি?

কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য মূলত পাঁচটি শর্ত রয়েছে। এই শর্তগুলো পূরণ হলে কুরবানী করা ওয়াজিব হয়। শর্তগুলো হলো:

১. মুসলমান হওয়া – কাফেরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
২. বালেগ (প্রাপ্তবয়স্ক) হওয়া – নাবালকের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
৩. আক্বিল (বুদ্ধিমান) হওয়া – পাগলের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
৪. মুকিম (স্থানীয়) হওয়া – মুসাফিরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
৫. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা – ঈদের দিন এবং তিন দিন পর্যন্ত নিজের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে (আবশ্যকীয় খরচ বাদে) যদি কারো কাছে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা (বা সমমূল্যের সম্পদ) থাকে, তাহলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়।

কুরবানী করা কি ফরজ না ওয়াজিব?

কুরবানী করা ফরজ নয়, তবে ওয়াজিব। কুরবানী করা ইসলামে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা ওয়াজিব অর্থাৎ অবশ্যই পালন করা উচিত। 

তবে ফরজ নয়, তাই যে ব্যক্তি তা না করবে, সে গুনাহগার হবে, কিন্তু কাফের (ইসলাম থেকে বের) হবে না।

ওয়াজিব এর অর্থ হলো: যে কাজ করার নির্দেশ শরীয়তে এসেছে, এবং তা কোনো স্পষ্ট ও জোরালো প্রমাণ (কুরআন বা হাদিস) দ্বারা প্রমাণিত, তবে ফরজের মতো বাধ্যতামূলক নয়। উদাহরণ: কুরবানী, বিতরের নামাজ ইত্যাদি।

কুরবানী না করার শাস্তি

কুরবানী না করার শাস্তি সম্পর্কে ইসলামী শরীয়তে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: যার উপর কুরবানী ওয়াজিব (শর্তগুলো পূরণ হলে), সে যদি উদাসীনতা বা অবহেলা করে কুরবানী না করে, তবে সে গুনাহগার হবে।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: "যে ব্যক্তি কুরবানী করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।" (আহমাদ, ইবন মাজাহ, হাকিম, সহীহ)।

এ থেকে বোঝা যায়, কুরবানী না করা বড় গুনাহ, যা ঈমানের দুর্বলতার আলামত। তবে কুরবানী না করলে কাফের (অবিশ্বাসী) হবে না।

কুরবানী সম্পর্কে হাদিস

কুরবানী সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হাদিস রয়েছে। নিচে কিছু প্রসিদ্ধ হাদিস তুলে ধরলাম:

১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: "আদম সন্তানের কোনো কাজ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে কুরবানীর চেয়ে অধিক প্রিয় হবে না। 

কুরবানীর পশু কিয়ামতের দিন শিং, খুর ও পশমসহ আগের অবস্থায় উঠানো হবে। এবং এর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। 

সুতরাং তোমরা খুশি মনে কুরবানি দাও।" (তিরমিজি, ইবন মাজাহ)

২. "যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।" (আহমাদ, ইবন মাজাহ, হাকিম)

৩. "তোমরা কুরবানীর পশুর মাংস খাও এবং কিছু গরীবদেরকে খাওয়াও।" (বুখারী, মুসলিম)

৪. হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত: "রাসূল (সা.) বলেছেন, কুরবানীর দিন মানুষের কোনো কাজ আল্লাহর কাছে পশু কুরবানির চেয়ে বেশি প্রিয় নয়।" (তিরমিজি)

কোরবানির মাংস বন্টনের নিয়ম

কুরবানির মাংস বণ্টনের নিয়ম সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ইসলামী শরীয়তে। আসুন ধাপে ধাপে দেখি:

কুরবানির মাংস বণ্টনের নিয়ম:

১️⃣ তিন ভাগে ভাগ করা সুন্নত: এক ভাগ নিজে এবং নিজের পরিবারের জন্য রাখা। এক ভাগ গরীব-মিসকিনদের মাঝে বিতরণ করা। এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের মধ্যে বিতরণ করা

২️⃣ গরীব-দুঃখীদের দেওয়া অংশে শর্ত: যাকাত গ্রহণের যোগ্যদের (যেমন গরীব, মিসকিন) মধ্যে দিতে হবে। ধনী ব্যক্তিদের (যারা নিজে কুরবানী দিতে সক্ষম) এই অংশ দেওয়া যাবে না।

৩️⃣ আপনি চাইলে পুরো মাংস দান করতে পারেন – কুরআন বা হাদিসে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে তিন ভাগে ভাগ করতেই হবে। তবে রাসূল (সা.)-এর সুন্নতের কারণে তিন ভাগে ভাগ করা উত্তম।

৪️⃣ কুরবানির চামড়া, মাথা বা পা – এগুলো বিক্রি করা বা হাদিয়া হিসেবে কোনো ভাড়া খাটানোর ক্ষেত্রে দেওয়া উচিত নয়। এগুলোও দান বা নিজের জন্য ব্যবহার করা যায়।

৫️⃣ কুরবানীর মাংস বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ – কোনো অংশ বিক্রি করা যাবে না, এমনকি কসাই মজুরি হিসেবেও দেওয়া যাবে না।

কোরবানির নিয়ম

কুরবানির নিয়ম ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের মধ্যে অন্যতম। সংক্ষেপে কুরবানির নিয়মগুলো ধাপে ধাপে নিচে দিচ্ছি: কুরবানির নিয়ম (সংক্ষেপে)

১. কুরবানীর শর্তসমূহ: মুসলমান হতে হবে। বালেগ (প্রাপ্তবয়স্ক) হতে হবে মুকিম হতে হবে (অর্থাৎ মুসাফির হলে কুরবানী ওয়াজিব নয়)। নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে (যেমন সাড়ে ৫২ তোলা রূপা বা সমমূল্য)।

২. কুরবানীর সময়: ঈদুল আযহার নামাজের পর থেকে ১২ জিলহজের মাগরিব পর্যন্ত। এর আগে কুরবানি করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।

৩. কুরবানীর পশুর ধরন: উট, গরু, মহিষ (এক উট/গরু/মহিষে ৭ জন পর্যন্ত শরিক হতে পারে)। ছাগল, ভেড়া (প্রতিটি এক ব্যক্তির জন্য)। 

পশু হতে হবে নির্দিষ্ট বয়সের (ছাগল-১ বছর, ভেড়া-৬ মাসের বেশি, গরু-২ বছর, উট-৫ বছর)। পশু সুস্থ, সম্পূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গযুক্ত হতে হবে (অন্ধ, পঙ্গু, খুব দুর্বল পশু গ্রহণযোগ্য নয়)।

4. নিয়ত (উদ্দেশ্য): কুরবানীর পশু জবাই করার সময় আল্লাহর নাম নিয়ে নিয়ত করতে হবে: “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, হাদা মিনাল্লাহি লাকা” (অর্থ: আল্লাহর নামে, আল্লাহ মহান, এই পশু আল্লাহর জন্য)।

৫. জবাই পদ্ধতি: পশুকে পূর্ব দিকে বা কিবলার দিকে শুইয়ে বাম পা বাঁধা এবং ডান পা খোলা রাখতে হবে। ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে। পশুর শিরা-উপশিরা কেটে রক্ত বের করে দিতে হবে।

৬. কুরবানীর মাংস বণ্টন: তিন ভাগে: নিজের জন্য, গরীবদের জন্য, আত্মীয়দের জন্য। কসাইকে মজুরি হিসেবে কুরবানীর কোনো অংশ (মাংস, চামড়া) দিতে হবে না। এগুলো কুরবানীর মূল নিয়ম। 

মন্তব্য। কোরবানির আসল উদ্দেশ্য কি-কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কয়টি



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url