আকিকা না দিলে কি হয় ও আকিকা না দিলে কি কোরবানি হয়?

আকিকা না দিলে কি হয়, আকিকা না দিলে কি কোরবানি হয়? এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের অনেকেরি সঠিক ধারণা বা তথ্য জানা নাই। অনেকেই এই বিষয়টি নিয়ে দুবিধায় ভুগে থাকি। তাদের জন্য আজকের এই পোস্টটি।
আজকের এই পোস্টটি পড়ার মাধ্যমে আপনাদের সেই দুবিধা দূর হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। এবং আকিকা না দিলে কি হয় ও আকিকা না দিলে কি কোরবানি হয়? এই সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

আকিকা অর্থ কি?

“আকিকা” (আরবি: العقيقة) একটি ইসলামি ধর্মীয় রীতি, যার অর্থ হলো—নবজাতক সন্তানের জন্ম উপলক্ষে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মে পশু কোরবানি দেওয়া।

আকিকার মূল উদ্দেশ্য: আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সন্তানের জন্মের জন্য। সন্তানের কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা। সমাজে এই আনন্দ ভাগাভাগি করা।

আকিকার নিয়মাবলি (সংক্ষিপ্ত):
  • ছেলের জন্য দুটি ছাগল/ভেড়া/দুম্বা কোরবানি করা সুন্নত।
  • মেয়ের জন্য একটি কোরবানি করা সুন্নত।
  • এটি সাধারণত সন্তানের জন্মের সপ্তম দিনে করা হয়, তবে পরে করলেও জায়েজ আছে।
  • ঐ দিন মাথার চুল মুণ্ডন করে ওজন পরিমাণ রূপা সদকা দেওয়া উত্তম।
আকিকা শুধু একটি কোরবানি নয়, বরং তা একটি ইসলামী ঐতিহ্য এবং সন্তানের জন্য বরকতের দোয়া। 

আকিকা না দিলে কি হয়?

আকিকা না দিলে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনো গুনাহ হয় না। কারণ আকিকা ফরজ বা ওয়াজিব নয়, বরং এটি সুন্নাতে মুআক্কাদা (অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত)।

তাহলে আকিকা না দিলে কী হয়?
গুনাহ হয় না, তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত পালন করা হয় না। যা থেকে আপনি ও আপনার সন্তান অনেক বরকত ও ফজিলত থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। 

হাদিস অনুযায়ী, আকিকা সন্তানের জন্য একটি নিরাপত্তা বা সুরক্ষা স্বরূপ। তাই আকিকা না করা হলে সন্তানের কল্যাণের জন্য একটি সুন্দর আমল বাদ পড়ে যায়।


কিছু হাদিসে এসেছে: "প্রত্যেক নবজাতক তার আকিকার দ্বারা বন্ধক থাকে"। অর্থাৎ আকিকা না দেওয়া পর্যন্ত তার পক্ষে কিছু আমল বা দোয়া পূর্ণরূপে সম্পন্ন হয় না — এমন ব্যাখ্যাও আলেমদের থেকে পাওয়া যায়।

পরে দেওয়া যায় কি?
হ্যাঁ, যদি সপ্তম দিনে না করা হয়, তাহলে পরে দেওয়া যায়—সন্তান বড় হয়ে গেলে এমনকি সে নিজেও নিজের আকিকা করতে পারে (তবে এটা নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে)।

আকিকা না দিলে গুনাহ না হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত ছুটে যায় এবং বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়া সম্ভব থাকে। তাই সাধ্যমতো আকিকা করাই উত্তম।

আকিকা না দিলে কি কোরবানি হয়?

এই প্রশ্নটি—"আকিকা না দিলে কি কোরবানি হয়?"—দুইভাবে বোঝা যেতে পারে। নিচে উভয় অর্থে বোঝানোর জন্য কিছু ব্যাখ্যা উল্লেখ করা হলো।

১. আকিকা না করলে কি কোরবানির আমল বাতিল হয়ে যায় বা অকার্যকর হয়?

না, হয় না। আকিকা এবং কোরবানি (ঈদের কোরবানি) সম্পূর্ণ আলাদা ইবাদত। আকিকা নবজাতকের জন্ম উপলক্ষে করা সুন্নাত। কোরবানি ঈদুল আজহার দিনে নির্ধারিত ব্যক্তিদের জন্য ওয়াজিব (সামর্থ্য থাকলে)। 

সুতরাং, যদি কেউ আকিকা না করে, তাতে তার কোরবানি (ঈদের) ইবাদতে কোনো সমস্যা হয় না।

২. আকিকার বদলে কোরবানি দিলে কি আকিকার নিয়ত পূর্ণ হয়?
না, হয় না। কোরবানি ঈদের নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট নিয়মে দেওয়া হয়, যা আল্লাহর এক বিশেষ হুকুম। আকিকা নবজাতকের জন্য নির্দিষ্ট একটি ইবাদত ও নিয়তের বিষয়। 

অন্য ইবাদত দ্বারা একটির নিয়ত পূরণ করা যায় না, যেমন: নামাজের বদলে রোজা রাখলে নামাজ আদায় হয় না। তেমনি কোরবানির পশু জবাই করে আকিকার নিয়ত করলেও তা আকিকা হবে না (সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী)।

সংক্ষেপে:
  • আকিকা না দিলে কোরবানি বাতিল হয় না।
  • কোরবানি দিয়ে আকিকার কাজ সম্পন্ন হয় না।
  • প্রতিটা ইবাদত তার নিজস্ব নিয়ম ও উদ্দেশ্যে সম্পাদন করতে হয়।

জন্মের কতদিন পর আকিকা দিতে হয়?

আকিকা দেওয়ার সর্বোত্তম সময় হলো—সন্তানের জন্মের সপ্তম দিন।

হাদিস অনুযায়ী: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক সন্তান তার আকিকার দ্বারা বন্ধক থাকে। সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু জবাই করা হয়, মাথা মুণ্ডানো হয় এবং নাম রাখা হয়।” —(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২৮৩৮)

তবে যদি সপ্তম দিনে না হয়: ১৪তম দিন বা ২১তম দিনেও দেওয়া যেতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট দিন না মিললে পরবর্তীতে যে কোনো সময় দিলেও জায়েজ আছে। কেউ কেউ বালেগ হওয়ার আগেই দেওয়া ভালো বলেন।

যদি বয়স্ক হয়ে যায়?
সন্তান বড় হয়ে গেলে সে চাইলে নিজেও নিজের পক্ষ থেকে আকিকা দিতে পারে (এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে কিছু মতভেদ আছে)।

সংক্ষেপে:
  • সর্বোত্তম: জন্মের ৭ম দিন।
  • পরিকল্পনামাফিক: ৭ম, ১৪তম, ২১তম দিন।
  • প্রয়োজনে: পরে যেকোনো সময়।

কত বছর বয়স পর্যন্ত আকিকা দেওয়া যায়

আকিকা দেওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সর্বোচ্চ বয়সসীমা নেই। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে তুলে ধরা হলো:

১. সর্বোত্তম সময়: জন্মের ৭ম দিন—সুন্নাহ অনুযায়ী সবচেয়ে ভালো সময়। ১৪তম বা ২১তম দিনেও দেওয়া যায়। এরপর যেকোনো সময় দিলেও জায়েজ (যথেষ্ট) হয়।

২. সন্তান বড় হয়ে গেলে কী হবে?
যদি বাবা-মা ছোটবেলায় আকিকা না দেন, সন্তান বড় হয়ে নিজের পক্ষ থেকে আকিকা দিতে পারেন—এটা অনেক ফকিহ ও আলেমের মতে জায়েজ।

উদাহরণ: রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই বড় বয়সে নিজের আকিকা করেছেন—এমন একটি হাদিস সুনানে বাইহাকিতে বর্ণিত।

৩. কত বছর বয়স পর্যন্ত দেওয়া যায়?
শরিয়তে কোনো সর্বোচ্চ বয়সসীমা নির্ধারিত নেই। এমনকি কেউ ২০, ৩০ বা তার বেশি বয়সেও আকিকা দিতে চাইলে দিতে পারে। মূল শর্ত হলো: ইচ্ছা ও সামর্থ্য।

সংক্ষেপে:

আকিকা ছোটবেলায় না হলে বড় হয়েও দেওয়া যায়, এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতেও। তবে যত দ্রুত সম্ভব দেওয়াই সুন্নাতের প্রতি যত্নশীলতা প্রকাশ করে।

ঋণ করে আকিকা দেওয়া যাবে কি?

না, ঋণ করে আকিকা দেওয়া আবশ্যক নয়, বরং নিরুৎসাহিত।

বিস্তারিত ব্যাখ্যা: আকিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত, কিন্তু ফরজ বা ওয়াজিব নয়। তাই যদি কারও আর্থিক সামর্থ্য না থাকে, তাহলে ঋণ করে আকিকা দেওয়া জরুরি নয় এবং ইসলাম এতে উৎসাহও দেয় না।

কেন ঋণ করে দেওয়া উচিত নয়: আকিকা সামর্থ্যসাপেক্ষ আমল — যাদের সামর্থ্য আছে, তারা করলেই সুন্নাত আদায় হয়। ঋণ ইসলামে বোঝা — ঋণের বোঝা না থাকাই ভালো। 

অপ্রয়োজনীয় ঋণ নেওয়া নিরুৎসাহিত। নবজাতক বা সন্তানের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে নিজেকে অর্থকষ্টে ফেলা ইসলাম সমর্থন করে না।

আলেমদের মতামত: অনেক ফকিহ ও আলেম বলেন। “যদি কারো সামর্থ্য না থাকে, তাহলে তার ওপর আকিকা নেই।”কেউ কেউ বলেন, “ঋণ যদি সহজে শোধ করা যায় এমন হয়, তাহলে বৈধ, কিন্তু তা-ও উত্তম নয়।”

বিকল্প করণীয়: পরে সামর্থ্য হলে আকিকা দেওয়া যায়। চাইলে কিছু মিষ্টি বা হালকা আপ্যায়ন করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা যেতে পারে।

ঋণ করে আকিকা দেওয়া জরুরি নয়। সামর্থ্য হলে করুন, না হলে আল্লাহ মাফ করবেন। ইসলামে “সহজতা”র নীতিই মূল।

ছেলেদের আকিকা দেওয়ার নিয়ম

ছেলেদের আকিকা দেওয়ার নিয়ম ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী কিছু নির্দিষ্ট সুন্নাত পদ্ধতির মাধ্যমে করা হয়। নিচে সহজভাবে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:

১. সময়
  • সর্বোত্তম দিন: জন্মের ৭ম দিন
  • না পারলে ১৪তম, ২১তম, অথবা পরবর্তী যেকোনো দিনেও দেওয়া যায়।
২. পশু সংখ্যা ও ধরণ
  • ছেলের জন্য ২টি ছাগল, ভেড়া, দুম্বা অথবা গরু/উটের সমমূল্যের অংশ।
  • পশু হতে হবে সুস্থ, দাগহীন ও কোরবানির জন্য উপযুক্ত।
৩. করণীয় (সুন্নাহ অনুসারে):
  • ‌‌‌আকিকার পশু জবাই: সন্তানের পক্ষ থেকে “আল্লাহর নামে” নেয়ত করে জবাই করতে হবে।উদাহরণ: “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, হা-যা ‘আকীকাতু (ফুল নাম)”
  • মাথার চুল মুন্ডানো: জবাইয়ের দিন সন্তানের মাথার চুল কামিয়ে তা ওজন করে সমপরিমাণ রূপা সদকা দেওয়া সুন্নত।
  • নাম রাখা: ওই দিন সন্তানের সুন্দর অর্থবোধক ইসলামি নাম রাখাও সুন্নত।
  • গোশত বণ্টন: গোশত নিজে খাওয়া, আত্মীয়-স্বজন ও গরিবদের মধ্যে বণ্টন করা যায়। কোরবানির মতো ৩ ভাগ করার বাধ্যবাধকতা নেই, তবে বণ্টন করা উত্তম। চামড়া বা অংশ বিক্রি করা জায়েজ নয়।
  • দোয়া ও শুকরিয়া: সন্তানের মঙ্গল কামনা করে দোয়া করা ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা।
সংক্ষেপে: ছেলের আকিকায় ২টি পশু কোরবানি করা সুন্নত, ৭ম দিনে মাথা মুণ্ডানো ও সদকা দেওয়া উত্তম, নাম রাখা এবং দোয়া করা উচিত।

মন্তব্য। আকিকা না দিলে কি হয় ও আকিকা না দিলে কি কোরবানি হয়?

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url