দাঁড়িয়ে পানি পান করলে কি হয়
দাঁড়িয়ে পানি পান করলে কি হয়?
- শরীরের অবস্থান ও পানি পানের সম্পর্ক: আধুনিক চিকিৎসা মতে, শরীর দাঁড়িয়ে থাকুক বা বসে—পানি শরীরে ঠিকভাবেই শোষিত হয়। শরীরের অ্যাবজর্পশন (absorption) সিস্টেম অঙ্গভেদে পানি গ্রহণ করে থাকে, এবং এটির উপরে পান করার অবস্থানের সরাসরি কোনো প্রমাণিত প্রভাব নেই।
- কিন্তু কিছু ব্যবহারিক বিষয় আছে: দাঁড়িয়ে পানি পান করলে অনেক সময় মানুষ দ্রুত পান করে ফেলে, ফলে এয়ার স্ব্যালোইং (air swallowing) হয়, যেটা গ্যাস বা ফাঁপা পেটের কারণ হতে পারে।
- বসে ধীরে পানি পান করলে শরীর সময় নিয়ে সেটা গ্রহণ করে, এবং আপনি পানির পরিমাণ ও খাওয়ার গতি সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
- গবেষণার তথ্য (সীমিত): ২০১২ সালে একটি ছোট্ট গবেষণায় দেখা যায়, দাঁড়িয়ে পানি পান করলে সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম বেশি অ্যাকটিভ হয়, যা সাময়িক চাপ বা স্ট্রেস বাড়াতে পারে। তবে এটি ক্ষতিকর কিনা, তা বোঝার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন।
- চিকিৎসকদের পরামর্শ (সাধারণ অভ্যাসের জন্য): বসে পানি পান ভালো ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস, কারণ তা হজম, শোষণ ও সচেতনতার দিক থেকে সহায়ক।
দাঁড়িয়ে পানি পান ইসলাম কি বলে
ইসলামে দাঁড়িয়ে পানি পান করার বিষয়টি নিয়ে কিছু হাদিসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, আবার কিছু হাদিসে নবী (সা.)-এর দাঁড়িয়ে পানি পান করার বর্ণনাও রয়েছে।
তাই উলামায়ে কেরাম বিষয়টি বিশ্লেষণ করে বলেছেন: এটি মাকরুহ (অপসন্দনীয়), হারাম নয়। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. দাঁড়িয়ে পানি পান করতে নিষেধাজ্ঞার হাদিসসমূহ:
- হাদিস ১: "রাসূলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে পানি পান করতে নিষেধ করেছেন।" — (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২০২৪)
- হাদিস ২: "তোমাদের কেউ যেন দাঁড়িয়ে পানি না পান। যে ভুলে গিয়ে দাঁড়িয়ে পান করেছে, সে যেন বমি করে দেয়।"— (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২০২৬)
এই হাদিসগুলো থেকে বোঝা যায়, বসে পানি পান করাই সুন্নত এবং দাঁড়িয়ে পান করা অপসন্দনীয়।
২. দাঁড়িয়ে পানি পান করার অনুমতির হাদিসসমূহ:
- হাদিস ৩: ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.) কে জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করতে দেখেছি।— (সহীহ বুখারী, হাদিস: ১৬৩৭)
এটি প্রমাণ করে যে, দাঁড়িয়ে পানি পান সর্বৈব নিষিদ্ধ নয়। প্রয়োজনে বা পরিস্থিতিভেদে এটি বৈধ।
৩. ইসলামিক স্কলারদের ব্যাখ্যা:
- ইমাম নববী (রহ.) বলেন: “দাঁড়িয়ে পানি পান করার নিষেধাজ্ঞার হাদিসটি 'নফরাত' (অপসন্দ) বোঝাতে বলা হয়েছে। হারাম বোঝাতে নয়।”
- ইমাম মালিক (রহ.) বলেন: “প্রয়োজন হলে দাঁড়িয়ে পান করা জায়েজ।”
- হানাফি মাজহাব মতে: দাঁড়িয়ে পানি পান করা মাকরুহে তানযিহি (অপসন্দনীয়, তবে গুনাহ নয়)।বসে পান করাই উত্তম এবং সুন্নতের অনুসরণ।
৪. কেন বসে পানি পান করা উত্তম?
- এটি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত।
- দাঁড়িয়ে পান করলে গলায় পানি দ্রুত যায়, শ্বাসরোধ বা কাশি হতে পারে।
- বসে পান করলে ধীরস্থিরতা থাকে, স্বাস্থ্য ও ভদ্রতার দিক থেকেও ভালো।
বসে পানি পান করার উপকারিতা
বসে পানি পান করার উপকারিতা শুধু ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, আদব এবং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান—তিন দিক থেকেই রয়েছে অসংখ্য উপকারিতা। নিচে তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
১. ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপকারিতা
- সুন্নত অনুসরণ: বসে পানি পান করা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিয়ম। সুন্নত অনুসরণে সাওয়াব পাওয়া যায়।
- আদব ও ভদ্রতা: বসে পানি পান করলে একজন মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলা ও বিনয় প্রকাশ পায়, যা ইসলামিক আদবের অংশ।
- জবাবদিহিতার মানসিকতা: ছোট ছোট আমলের মধ্য দিয়ে মানুষ আল্লাহর ভয় ও আনুগত্য শেখে, যা পরিশুদ্ধ চরিত্র গঠনে সাহায্য করে।
২. স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে উপকারিতা
- পরিপাকতন্ত্রের জন্য উপকারী: বসে পান করলে পানি ধীরে ধীরে খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে। এতে পাকস্থলীর পাচনতন্ত্র স্বাভাবিকভাবে কাজ করে।
- কিডনি সুস্থ রাখে: ধীরে ধীরে পানি শরীরে প্রবেশ করায় কিডনির উপর চাপ কম পড়ে। দাঁড়িয়ে পান করলে পানি হঠাৎ করে নিচের দিকে চাপ দেয়, কিডনির ফিল্টারিং সিস্টেম বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
- হৃদপিণ্ডের উপর চাপ কমে: বসে পানি পান করার ফলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে, হৃদপিণ্ডে বাড়তি চাপ পড়ে না।
- হাড় ও জোড়ার জন্য ভালো: দাঁড়িয়ে পান করলে অতিরিক্ত চাপ মেরুদণ্ড ও হাঁটুর জোড়ায় পড়ে।বসে পান করলে শরীরের ভারসাম্য ঠিক থাকে।
- গ্যাস ও অম্বলের সমস্যা কমে: দাঁড়িয়ে পান করলে অনেকের ক্ষেত্রে এসিড রিফ্লাক্স বা গ্যাসের সমস্যা বেড়ে যায়। বসে ধীরে পানি পান করলে এ সমস্যা কমে।
৩. আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান যা বলে: ভারতের আয়ুর্বেদ এবং জাপানি হেলথ কেয়ার গবেষণা মতে: “Standing and gulping water disrupts the balance of fluids, causes arthritis, kidney damage and nerve tension.” অর্থাৎ দাঁড়িয়ে পানি পান করলে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর উপর খারাপ প্রভাব পড়ে।
WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) মতে: “Drinking water in a calm posture (sitting) helps in optimal hydration and digestion.”
৪. মানসিক প্রশান্তি ও মনোযোগ বৃদ্ধি: বসে পান করলে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে পান করে। এতে শরীর-মন দুটোরই প্রশান্তি বাড়ে।
বাম হাতে পানি খাওয়া কি হারাম
বাম হাতে পানি খাওয়া ইসলামে হারাম নয়, তবে অপসন্দনীয় (মাকরুহ) এবং সুন্নতের খেলাফ। ইসলামে ডান হাত দিয়ে খাওয়া ও পান করা সুন্নত ও আদবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিচে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
হাদিস থেকে প্রমাণ: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-"তোমাদের কেউ যেন খাওয়ার সময় ডান হাত ব্যবহার করে এবং পান করার সময়ও ডান হাত ব্যবহার করে। কারণ শয়তান ডান হাতে খায় না, বাম হাতে খায় ও পান করে।"— (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২০২০)।
"নবী (সা.) এক ব্যক্তিকে বাম হাতে খেতে দেখে বললেন, ডান হাতে খাও। সে বলল, পারি না। রাসূল (সা.) বললেন, তুমি আর কখনো পারবে না। এরপর সে আর কখনো ডান হাতে খেতে পারেনি।"— (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২০২১)
এখানে অহংকার বা অবাধ্যতা থেকে বাম হাত ব্যবহার করায় আল্লাহর গজব নেমে আসে। এই হাদিস স্পষ্টভাবে ডান হাত দিয়ে খাওয়া-পান করার নির্দেশনা দেয় এবং বাম হাত দিয়ে খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে।
ইসলামিক স্কলারদের ব্যাখ্যা: ডান হাত ব্যবহার করা সুন্নত। ইচ্ছাকৃতভাবে বাম হাত ব্যবহার করা (যখন ডান হাত ব্যবহার সম্ভব)। এটা সুন্নতের খেলাফ ও গর্হিত কাজ বলে ধরা হয়। যদি কেউ অসুস্থতা বা অন্য কোনো বৈধ কারণে ডান হাত ব্যবহার করতে না পারে, তখন বাম হাতে খাওয়া-পান করা জায়েজ — গোনাহ হবে না।
দাঁড়িয়ে পানি পান করা নিয়ে হাদিস
৩. উলামাদের ব্যাখ্যা: ইসলামের বিভিন্ন মাজহাব অনুযায়ী:
- হানাফি মাজহাব: দাঁড়িয়ে পানি পান করা মাকরুহ, তবে জায়েজ (হারাম নয়)।
- শাফেয়ি মাজহাব: দাঁড়িয়ে পানি পান করা মাকরুহ, তবে অপেক্ষা করে বসে পান করা সুন্নত।
এছাড়া, কিছু স্কলার মনে করেন, দাঁড়িয়ে পানি পান করা শারীরিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ক্ষতিকর হতে পারে, কারণ এটি হজম বা পাকস্থলীতে পানি প্রবাহের জন্য উপযুক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারে না।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url