হিজামার উপকারিতা ও অপকারিতা জেনে নিন

হিজামার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে চলেছি আজকের এই পোস্টটিতে। আপনি কি হিজামা থেরাপি নিতে চান বা নেওয়ার কথা ভাবছেন।তাহলে আজকের এই পোস্টটি শুধুমাত্র আপনার জন্য উপকারী হতে চলেছে।
কেননা আজকের এই পোস্টটি পড়ার মাধ্যমে আপনি বিস্তারিতভাবে জানতে পারবেন হিজামার উপকারিতা ও অপকারিতা। আরও জানতে পারবেন হিজামা কিভাবে করা হয় ও কতদিন পর পর হিজামা করা যায় এবং হিজামার খরচ সম্পর্কে আলোচনা। বিস্তারিত জানতে এই পোস্টটির সাথেই থাকুন।

হিজামা থেরাপি কি?

হিজামা থেরাপি (Hijama Therapy) হলো একটি প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে কাপ (চোষণ যন্ত্র) ব্যবহার করে শরীরের নির্দিষ্ট অংশে রক্ত টেনে আনা হয় এবং এরপর সেই অংশ থেকে দূষিত রক্ত বের করে দেওয়া হয়।

এটি মূলত "কাপিং থেরাপি" নামে পরিচিত, এবং ইসলামী সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

হিজামার উপকারিতা ১০টি

হিজামা (Hijama), যেটি শুষ্ক বা ভেজা কপিং থেরাপি নামেও পরিচিত, এটি একটি প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি যা ইসলামী সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। 

এতে শরীর থেকে দূষিত রক্ত বের করে শরীরকে বিশুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। নিচে হিজামার ১০টি উপকারিতা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো:

১. রক্ত পরিশোধন ও টক্সিন অপসারণ

হিজামার মাধ্যমে শরীর থেকে দূষিত রক্ত বের করে দেয়া হয়, যা বিভিন্ন টক্সিন, দূষণ ও ক্ষতিকর উপাদান দূর করে। এটি শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে তোলে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

হিজামা রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে ও শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে চাঙ্গা করে তোলে। নিয়মিত হিজামা করলে শরীর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা পায়।

৩. ব্যথা ও অস্বস্তি হ্রাস

হিজামা ঘাড়, পিঠ, কোমর, হাঁটু বা মাথা ব্যথায় দারুণ উপকারী। এটি রক্ত চলাচল উন্নত করে এবং পেশীর সংকোচন ও স্নায়ুর উত্তেজনা কমায়।

৪. মাইগ্রেন ও মাথাব্যথার উপশম

হিজামা মাইগ্রেন ও মাথাব্যথা নিরাময়ে অনেক উপকারী বলে বিবেচিত। নিয়মিত হিজামা করলে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ ঠিক থাকে এবং মাথাব্যথা হ্রাস পায়।

৫. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমানো

হিজামা শরীর ও মনকে শান্ত করে। এটি নার্ভ সিস্টেমকে আরাম দেয় এবং স্ট্রেস হরমোন (কর্টিসল) কমিয়ে দেয়, যার ফলে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমে যায়।

৬. চর্মরোগের উপশম

সোরিয়াসিস, একজিমা ও ব্রণের মতো চর্মরোগের চিকিৎসায় হিজামা কার্যকর। এটি ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে এবং প্রদাহ কমিয়ে কাজ করে।

৭. হরমোন ভারসাম্য রক্ষা

হিজামা হরমোন নিঃসরণ প্রক্রিয়াকে সঠিক রাখে। এটি থাইরয়েড সমস্যা, পিরিয়ড অনিয়ম ও বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় উপকারী হতে পারে।

৮. হজম শক্তি বৃদ্ধি

হিজামা হজম তন্ত্রে রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে। এটি গ্যাস, অম্বল, বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে।

৯. ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক

হিজামা ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, যার ফলে ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশন রোগীদের উপকার হতে পারে।

১০. শরীরের শক্তি ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি

হিজামার মাধ্যমে শরীর চাঙা থাকে, ক্লান্তি কমে এবং প্রতিদিনের কাজের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এটি ক্রীড়াবিদদের জন্য বিশেষ উপকারী, কারণ এটি পুনরুদ্ধারের সময় কমিয়ে দেয়।

বিশেষ পরামর্শ: হিজামা অবশ্যই প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ হিজামা থেরাপিস্ট দ্বারা করা উচিত। রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে উপযুক্ত স্থান ও পদ্ধতি নির্ধারণ করা দরকার।

হিজামার অপকারিতা

হিজামা সাধারণত নিরাপদ একটি চিকিৎসা পদ্ধতি হলেও কিছু পরিস্থিতিতে বা ভুলভাবে করলে এর কিছু অপকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। নিচে হিজামার সম্ভাব্য অপকারিতা উল্লেখ করা হলো:

১. ত্বকের সংক্রমণ (ইনফেকশন)

যদি হিজামার সরঞ্জাম সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত না করা হয়, তাহলে ত্বকে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে ফোঁড়া, সংক্রমণ বা ঘা হতে পারে।

২. অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ

ভেজা হিজামায় (Wet Cupping) কেটে রক্ত বের করা হয়। যদি অনেক বেশি কাটা হয় বা রক্তপাত বন্ধ করতে বিলম্ব হয়, তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে।

৩. দুর্বলতা বা মাথা ঘোরা

অনেক সময় হিজামার পরে রোগীরা মাথা ঘোরা, ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করেন, বিশেষ করে যদি তারা উপোস অবস্থায় হিজামা করেন।

৪. আলর্জিক প্রতিক্রিয়া

কখনও কখনও ব্যবহৃত কাপ বা ত্বকে লাগানো তেল বা অয়েন্টমেন্টের উপাদানে অ্যালার্জি হতে পারে, ফলে ত্বকে র‍্যাশ বা চুলকানি দেখা দিতে পারে।

৫. আঘাতের চিহ্ন বা দাগ

হিজামার কাপ টানের কারণে ত্বকে গোল চিহ্ন বা কালো দাগ (bruise) থেকে যায়, যা কয়েক দিন বা সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

হিজামা করার আগে একজন প্রামাণিক ও প্রশিক্ষিত হিজামা থেরাপিস্ট নির্বাচন করা জরুরি এবং ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় হিজামা করা উচিত।

হিজামা কিভাবে করা হয়?

হিজামা কিভাবে করা হয় — এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত ধাপে ধাপে এবং অত্যন্ত পরিচ্ছন্নতা ও সতর্কতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। নিচে হিজামা করার ধাপগুলো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

 হিজামা করার ধাপসমূহ:

১. প্রস্তুতি ও রোগী যাচাই: রোগীর শারীরিক অবস্থা মূল্যায়ন করা হয় (যেমন: রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ওষুধ গ্রহণ ইত্যাদি)। রোগীকে জানানো হয় কীভাবে হিজামা কাজ করে। 

সাধারণত হিজামা করার ২-৩ ঘণ্টা আগে হালকা খাবার খেতে বলা হয়।

২. পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করা: যে অংশে হিজামা করা হবে তা ভালোভাবে অ্যালকোহল বা জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। থেরাপিস্ট গ্লাভস ও জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন।

৩. Dry Cupping (শুকনো কপিং): নির্দিষ্ট অংশে কাপ বসিয়ে সাকশন (চোষণ) তৈরি করা হয়। সাধারণত ৩–৫ মিনিট পর্যন্ত কাপ বসিয়ে রাখা হয়। এতে ত্বকের নিচে রক্ত জমে ফুলে উঠে আসে।

৪. Incision (কাটাছেড়া করা): সাকশন শেষে কাপ খুলে ছোট ছোট কাটাছেড়া (সাধারণত ব্লেড বা সুই দিয়ে) করা হয়। এটি খুব হালকা হয় — ত্বকের উপরিভাগেই।

৫. Wet Cupping (ভেজা কপিং): এরপর আবার কাপ বসানো হয়। এবার সেই কাটা স্থান থেকে দূষিত রক্ত বের হতে থাকে। ৫–১০ মিনিটের মধ্যে প্রয়োজনমতো রক্ত বের হয়ে যায়।

৬. কাপ সরানো ও পরিষ্কার করা: কাপ সরিয়ে ওই স্থান পরিষ্কার করা হয়। জীবাণুনাশক ও অ্যান্টিসেপটিক ওষুধ বা মলম লাগানো হয়। প্রয়োজনে ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়।

৭. পরবর্তী নির্দেশনা (Aftercare): রোগীকে বিশ্রাম করতে বলা হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গোসল না করতে বলা হয়। পানি বেশি খাওয়ার ও চর্বিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়।

গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা:
  • হিজামা অবশ্যই অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত থেরাপিস্টের কাছ থেকে করানো উচিত।
  • সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত না হলে সংক্রমণ হতে পারে।
  • হিজামার আগে ও পরে বিশ্রাম ও খাদ্যাভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ।

কতদিন পর পর হিজামা করা যায়?

হিজামা কতদিন পর পর করা যায় তা নির্ভর করে ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা, উদ্দেশ্য (চিকিৎসা না সুন্নাহ), এবং থেরাপিস্টের পরামর্শের উপর। তবে সাধারণভাবে নিচের নিয়মগুলো অনুসরণ করা যায়:

হিজামা করার সময়সূচি (সাধারণ নিয়ম):

১. সুন্নাহ অনুসারে হিজামা (সাধারণ সুস্থ ব্যক্তির জন্য): চন্দ্র মাসের ১৭, ১৯ ও ২১ তারিখে হিজামা করা উত্তম (হাদিস অনুযায়ী)। প্রতি ১ থেকে ৩ মাসে একবার হিজামা করা যায় সুস্থতা ও সুন্নাহ পালনের উদ্দেশ্যে।

২. চিকিৎসার উদ্দেশ্যে হিজামা: যদি কোনো ব্যথা, মাইগ্রেন, আর্থ্রাইটিস, ব্লকেজ বা চর্মরোগ থাকে, তবে ২–৪ সপ্তাহে একবার করা যেতে পারে। আবার নির্দিষ্ট কিছু রোগে ৭–১০ দিন অন্তরও থেরাপি করা যেতে পারে (থেরাপিস্টের পরামর্শে)।

৩. সাধারণ সুস্থ ব্যক্তির জন্য রুটিন হিজামা: প্রতি ৩ মাসে একবার করা ভালো শরীর ডিটক্স ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য।

বিস্মরণীয় বিষয়: অতিরিক্ত হিজামা শরীর দুর্বল করে দিতে পারে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ছাড়া ঘন ঘন হিজামা করা উচিত নয়।

হিজামা খরচ কতো?

হিজামা থেরাপির খরচ স্থান, থেরাপিস্টের অভিজ্ঞতা, ব্যবহৃত উপকরণ ও সেবার মান অনুসারে ভিন্ন হতে পারে। নিচে সাধারণভাবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে হিজামার খরচ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হলো:

হিজামা খরচ (বাংলাদেশে ও অনুরূপ দেশগুলোতে)

১. সাধারণ হিজামা (১–৩ পয়েন্ট): ৳৫০০ – ৳১০০০ টাকার মধ্যে হতে পারে। Dry Cupping হলে কিছুটা কম খরচ হয়

২. চিকিৎসা ভিত্তিক হিজামা (৪–৮ পয়েন্ট): ৳১২০০ – ৳২৫০০ পর্যন্ত হতে পারে। যেমন: ব্যথা, মাইগ্রেন, ঘাড়/পিঠে ব্লকেজ ইত্যাদির জন্য।

৩. সম্পূর্ণ শরীরের হিজামা বা বিশেষ থেরাপি: ৳৩০০০ – ৳৫০০০ বা তার বেশি। সেশনের সংখ্যা ও থেরাপিস্টের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে

বিশেষ লক্ষণীয় বিষয়:
  • প্রাইভেট ক্লিনিক বা স্পা সেন্টারে খরচ বেশি হতে পারে।
  • ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে (মসজিদ বা ওয়াকফ পরিচালিত কেন্দ্রে) কিছু জায়গায় স্বল্পমূল্যে বা ফ্রি হিজামা করা হয়।
  • খরচের সঙ্গে ওষুধ, অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, ব্যান্ডেজ ইত্যাদির খরচ আলাদাভাবে যোগ হতে পারে।

হিজামা কতো প্রকার

হিজামার উপকারিতা ও অপকারিতার এই প্রতিবেদনটিতে থাকছে হিজামা থেরাপির ধরন বা প্রকারভেদ। হিজামা দুই ধরনের হতে পারে। যথাঃ

১। Dry Cupping (শুষ্ক হিজামা): কেবল কাপ বসিয়ে রক্ত টেনে আনা হয়, কাটা হয় না। এতে রক্ত বের করা হয় না, কেবল সঞ্চালন উন্নত করা হয়।

২। Wet Cupping (ভেজা হিজামা): কাপ বসানোর পর হালকা কাটাছেঁড়া করে সেই অংশ থেকে দূষিত রক্ত বের করে দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়াই মূলত “হিজামা” নামে বেশি পরিচিত।

মন্তব্য। হিজামার উপকারিতা ও অপকারিতা

পাঠক, আশা করি আজকের এই আর্টিকেলটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারী ও ধৈর্য ধরে পড়েছেন। পড়ার মাধ্যমে ইতিপূর্বে জানতে পেরেছেন হিজামার উপকারিতা ও অপকারিতা। 

আপনাদের যদি এই আর্টিকেলটি পড়ে ভালো লেগে থাকে, তবে আপনাদের প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন।

এই রকম আরোও গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল পেতে নিয়মিত আমার www.sumonworld.com ওয়েবসাইটটি পরিদর্শন করুন। 

আবারও দেখা হবে নতুন কোন এক আর্টিকেলের মাধ্যমে। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। ভাল থাকুন এবং প্রিয়জনদের ভালবাসুন। আল্লাহ হাফেজ❤️

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url